আমরা আজ এক যুগ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের ব্যক্তি জীবন অচল হয়ে গেছে - রাষ্ট্রিয় জীবন অচল - বিশ্ব ব্যবস্থাও এক অচলায়তনে পর্যভূষিত। আমরা রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে চেষ্টা করেছি। আমরা অর্থনীতি দিয়ে চেষ্টা করেছি। আমরা সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে চেষ্টা করেছি। কিন্তু কিছুতেই যেন সমাধান হয়না - আমরা আটকে গেছি এক কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায়। প্রচন্ড চাপে অথবা চাপ সৃষ্টি ক'রে বাঁচতে হচ্ছে মানুষকে।
হাজার বছর ধ'রে মানুষ ধর্ম দিয়ে চেষ্টা ক'রেছে। এতে গিয়ে আরো জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। সবার দাবি তার ধর্মই সঠিক পথ দেখিয়েছে। যদি অক্ষরে অক্ষরে মানা হয় তবে নিশ্চিত তার পথ ধ'রে পৌঁছে যাওয়া যাবে অভিষ্ট লক্ষ্যে। কিন্তু সমস্যা একটাই কোনটা সঠিক ধর্ম। প্রত্যেকে বলছেন তাঁরটাই সঠিক আর অন্যটা ভুল পথ। আর এর বাইরে যারা আছে তারা বিপথগামী। অন্যেরটা ভুল না হ'লেও তারটাই সর্বত্তোম রাস্তা। মানুষে মানুষে হানাহানি - তোমরা আর আমরা আর তারা - বিচ্ছিন্ন সবাই পরস্পর থেকে। কিন্তু সবার একই উদ্দেশ্য - সুখ শান্তি সমৃদ্ধি। কিন্তু সবাই মিলে কোনো ভাবেই সেখানে পৌঁছাতে পারছিনা। সোনার হরিণ কেবল স্বপ্নই, বাস্তবে পাওয়া গেল না। বরং আরো অসম্ভব হ'য়ে উঠছে দিনে দিনে। আর এদিকে ক্রমে ফুরিয়ে যাচ্ছে জ্বালানি, শেষ হ'য়ে যাচ্ছে আবাদের যথেষ্ট জমি। বিশুদ্ধ খাবার পানি, শুদ্ধবায়ু।
বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতি কিন্তু মানুষ অভুক্ত চিকিৎসাহীন হ'য়ে মরছে। জাতীয়তার নামে ধর্মের নামে নিঃসংকোচে মানুষ মানুষকে মারছে। নানান প্রাকৃতিক বিপর্যয় উজার ক'রে দিচ্ছে আমাদের কত জনপদ।
আমরা কত আদিম এখনো। আমাদের পাশেই মানুষ মরছে। মারছে মানুষ মানুষকে। আমরা নির্বিকার নিরুপদ্রব জীবন যাপন ক'রে যাচ্ছি। কাজ করছি, খাচ্ছিদাচ্ছি, বিয়ে ক'রছি। ছেলেমেয়ের মা বাবা হচ্ছি। প্রমোশন পাচ্ছি, বুড়ো হচ্ছি, রিটায়ার করছি। এবং এক সময় ম'রে যাচ্ছি। কি অর্থ এসবের। কি করতে চাচ্ছি? কেন চাচ্ছি। বেঁচে থাকাটাই এক যুদ্ধ। কেন বাঁচবো?
সবারমত - কিংবা অনেকের মতো অনেক প্রশ্ন আমাকে বার বার বিদ্ধ ক'রে। যখন নিজের জীবনটা অচল হ'য়ে পড়ে তখন জানতে চাই কেন আমার জীবন এমন ক'রে ব্যর্থ হ'য়ে যাচ্ছে। কেন যা চাচ্ছি তা পাচ্ছি না? কেন সুখ শান্তি নিত্য আমাকে কলা দেখিয়ে অতৃপ্তিতে ভ'রে দেয় জীবন। অনেক সংগ্রামের পরও কেন অর্থ আমার জীবনকে অর্থহীন ক'রে দেয়। কেন আর্থিক স্বাচ্ছন্দ আমাকে বারবার ধরা দিতে দিতেও দেয়না। একদিনতো বিশাল এক মানুষকেই ক'রে ফেললাম এক বিরাট দার্শনিক প্রশ্ন? কিভাবে সততার সাথে জীবন যাপন ক'রেও আর্থিক সমৃদ্ধি লাভ করতে পারবো?
অনেক খোঁজখুঁজি করলাম। সংগ্রামে গেলাম, আন্দোলন করলাম। রাজনীতি করলাম, পার্টি করলাম, আত্ম উন্নয়ন প্রচেষ্টা কিংবা ধর্ম সাধনা। সবই যেন শেষ পর্যন্ত অর্থহীন। বই পড়তে খুব ভালো লাগে আমার। কিন্তু খুব ভালো পড়ুয়া না আমি। ভাষা জ্ঞান বাঙালের বাংলা আর গ্রামার পড়া ইংরেজি। আর কোনো ভাষা জানা নেই। তদুপরি এসে পড়েছি মধ্যপ্রাচ্যে। বই পাওয়া যায় এখানে খুব সীমিত। বাংলা নয় ইংরেজি। কিন্তু আমার চাকুরির স্থলে এক অপূর্ব সুযোগ রয়েছে - ইন্টারনেট। সময় খুব কম পেতাম কিন্তু খেপার মত কেবল বারবার খুঁজেছি কোনো রাস্তা আছে কি? না নেই।
একদিন হঠাৎ ক'রে এক বই এসে হাজির আমার সার্সে। ওসিআর স্ক্যান ক'রে পিডিএফ ফাইল বানিয়েছেন কোন এক সহৃদয় পাঠক (হ্যাকারও বলা যায় এক অর্থে)। কিন্তু এই লেখক ব্যাটা বলে কি? একই প্রশ্ন তারও। ---
"কেন আমার জীবন অচল হ’য়ে পড়ল? কিভাবে আমার জীবন সচল হবে? আমি কেন দাম্পত্য সম্পর্কে সুখী হতে পারছি না? আর্থিক স্বাচ্ছন্দের সুখ কি আমি কখনোই লাভ করতে পারবো না? সর্বোপরি আমি জানতে চাই, সত্যি আমি কি এমন করেছি যে আমাকে এমন একটা অবিরাম সংগ্রামের জীবন যাপন করতে হবে?" আর হঠাৎ এসবের উত্তর পেতে শুরু করলো সে। আমাদেরকে অবাক ক'রে দিয়ে এই বই আমাদের সামনে তুলে ধরে আমাদেরই কত পরিচিত সব উত্তর। আমাদের আহবান করে নিজের ভেতরে উত্তর খুঁজতে। এই বইটার লেখক নিল ডোনাল্ড ওয়্যাল্শ্ (Neale Donald Walsch)। বইয়ের নাম কনভার্সেশনস্ উইথ্ গড - ঈশ্বরের সঙ্গে কথোপকথন।
বিশ্বের আজ অনেক মানুষ নিলের মতই বিশ্বাস করেন যে, আমরা আজকে যে সমস্যার সম্মুখিন তা আমাদের ভেতরের সমস্যা। এর সমাধান আমাদের ভেতরের সত্যের পরিবর্তনের মাধ্যমেই হবে। বাইরে থেকে নয়। বরং ভেতর থেকে বাইরে। ঈশ্বরকে বাদ দিয়ে নয়। কিন্তু ঈশ্বর সম্পর্কে আমাদের ধারণার পরিবর্তনের মাধ্যমে। জীবন সম্পর্কে আমাদের ধারনার পরিবর্তনের মাধ্যমে। আমাদের নিজেদের সম্পর্কে ধারণার পরিবর্তনের মাধ্যমা। ভুল শুদ্ধ ন্যায় অন্যায় নয় বরং কি আমাদের জন্য কার্যকর বা কি আমাদের বারবার আটকে দিচ্ছে? আমি এই চমৎকার বইটা পড়তে আমন্ত্রন জানাবো - আরেকটা রাস্তার পথিকদেরকে।
জাতীয় শোক দিবসে যুক্ত হয়েছে তারেক মাসুদ আর মিশুক মনির সহ আর ৩জনের মর্মান্তক মৃত্যু। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা জানাই। শ্রদ্ধা জানাই মুক্তির দিগন্তের তারেক মাসুদকে, সাহসী সংবাদিক মিশুক মুনিরকে। আর যুগ যুগ ধরে স্বাধীনতাকামী মানুষদেরকে। বিশ্বের সব প্রাণকেই আমি শ্রদ্ধা জানাই।
তাপস দে
মাস্কাট/ ওমান
১৬ অগাষ্ট ২০১১
No comments:
Post a Comment